বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

তথ্য সংগ্রহ ও তথ্য চুরির মধ্যে পার্থক্য কী  

  • ড. সেলিম মাহমুদ    
  • ১৯ মে, ২০২১ ২২:৫৩

আমাদের দেশের সচিবালয়সহ সরকারি দপ্তরগুলোতে সাংবাদিকরা যেভাবে অবাধে তথ্য সংগ্রহ করেন, পৃথিবীর আর কোনো দেশে সাংবাদিকরা এতটা স্বাধীনতা ভোগ করেন না। তথ্য সংগ্রহের জন্য তথ্য চুরি শুধু অপরাধই নয়, এটি সংবিধানেরও লঙ্ঘন। সরকারি দপ্তরের কোনো কর্মকর্তার নথি থেকে গোপনে কাগজপত্র সরিয়ে নেয়া কিংবা গোপনে ছবি তুলে নেয়া তথ্য চুরির মধ্যে পড়ে। এই ধরনের অনৈতিক ও বেআইনি কাজ সাংবাদিকতার নীতিবিরোধী।

বাংলাদেশে বিরাজমান সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকের স্বাধীনতার সামগ্রিকতাকে আড়াল করে সাংবাদিক রোজিনার বিষয়টি নিয়ে একটি মহল যেভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং দেশে-বিদেশে এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেভাবে দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে, তাতে মনে হচ্ছে এটি একটি নতুন ষড়যন্ত্র। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই বিষয়টি নিয়ে কেউ কেউ এমনভাবে মন্তব্য করছেন যেন রাষ্ট্র সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বিমাতাসুলভ আচরণ করছে। সাংবাদিক রোজিনার বিষয়টি নিয়ে কেউ কেউ ধূম্রজাল তৈরি করার চেষ্টা করছে।

এই বিষয়ে কে অপরাধী, কে অপরাধী নয়- আমি এটি নিয়ে কোনো মন্তব্য করব না। এটি এখন একটি বিচারিক বিষয়। তবে আমাদের সংবিধান, প্রচলিত আইন ও নীতিনৈতিকতার আলোকে রাষ্ট্রীয় কোনো তথ্য জানার বা সংগ্রহ করার বিষয় নিয়ে কিছু বলব।

এটি বলার অপেক্ষা রাখে না, জননেত্রী শেখ হাসিনার কারণে আজ বাংলাদেশের গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকরা অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছেন। তিনিই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম করেছেন। দেশে এতগুলো প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অনুমোদন তিনিই দিয়েছেন। সাংবাদিকদের সামাজিক মর্যাদা ও সম্মান প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণের বিষয়ে তিনি ভীষণভাবে সংবেদনশীল ও সহানুভূতিশীল। এই বিষয়গুলো নতুন করে বলার দরকার নেই। এইসব বিষয় আমরা সবাই জানি।

তবে কিছু মৌলিক বিষয়ে আমাদের আরও ধারণা থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশে তথ্য অধিকারের বিষয়টি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাই প্রতিষ্ঠিত করেছেন তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ সংসদে প্রণয়ন করে। এই আইন অনুযায়ী স্বাধীন তথ্য কমিশন তিনিই গঠন করেছিলেন। সেই সামরিক সরকারের সময় থেকে এই ধরনের একটি কমিশনের কথা অনেকেই বলে আসছিল। শেখ হাসিনার সরকার ছাড়া কোনো সরকারই এটি করার উদ্যোগ নেয়নি। তথ্য অধিকার আইনের মাধ্যমে সাংবাদিকসহ সকলেরই তথ্য জানার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু অনেকেই এটি করছেন না। অনেকেই বুঝে বা না বুঝে অফিশিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট নিয়ে কথা বলছেন। ১৯২৩ সালে প্রবর্তিত এই আইন উপমহাদেশের সকল দেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বিদ্যমান রয়েছে। আওয়ামী লীগের বাইরে কোনো সরকারের সময় এই আইন নিয়ে কথা হয়নি। শুধু আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এই সকল বিষয় কেন আনা হয়?

তথ্য সংগ্রহ আর তথ্য চুরির পার্থক্যটা আমাদের বুঝতে হবে। তথ্য চুরি করা একটি অপরাধ। আমাদের মনে রাখতে হবে, তথ্য সংগ্রহের বিষয়টি পৃথিবীর সকল দেশেই সংবিধান এবং আইনের আওতাধীন। সংবিধান এবং আইন মেনেই সকল দেশে সরকারি বা রাষ্ট্রীয় তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। পৃথিবীর কোথাও রাষ্ট্রীয় বা সরকারি তথ্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় না। এটি সব সময়ই নিয়ন্ত্রিত রাখা হয়। আমাদের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী গণমাধ্যমকেও কিছু বিধিনিষেধ মেনে নিয়ে কাজ করতে হয়।

একটি বিষয় আমরা অনেকেই খেয়াল করি না, আমাদের সংবিধানসহ পৃথিবীর সকল দেশের সংবিধানে গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টি সংবিধানের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য (basic feature of the constitution)। কারণ সংবিধান অনুযায়ী (সংবিধানের তৃতীয় তফসিল অনুযায়ী), মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সকল মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী দুটি শপথ পাঠ করেন। একটি সাধারণ শপথ অর্থাৎ আনুগত্য ও সংবিধান রক্ষার শপথ এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে গোপনীয়তার শপথ। অর্থাৎ রাষ্ট্রের কার্যাবলির গোপনীয়তা রক্ষা করা একটি সাংবিধানিক অঙ্গীকার এবং সাংবিধানিক দায়িত্ব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে যে সকল বিষয় আসে, সেগুলো বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর থেকে আসে। এই সকল মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের নথিগুলোতে এই সকল তথ্য থাকে।

যেখানে প্রধানমন্ত্রী এবং অন্য সকল মন্ত্রী সংবিধান অনুযায়ী শপথ নিচ্ছেন, তাদের সামনে উপস্থাপিত সকল বিষয়ের গোপনীয়তা তারা রক্ষা করবেন, সেখানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর থেকে সেই তথ্যগুলো যখন কেউ প্রকাশ করে দেয় কিংবা কেউ যখন এই তথ্য চুরি করে, এটি শুধু চুরিই নয়, এটি সংবিধানেরও লঙ্ঘন। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় বা সরকারি তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করা একটি সাংবিধানিক দায়িত্ব।

সাংবাদিকসহ যেকোনো ব্যক্তি তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে তথ্য অধিকার আইনের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করবেন। তথ্য পেতে কোনো প্রতিবন্ধকতার শিকার হলে তথ্য কমিশনে অভিযোগ দায়েরের ব্যবস্থা আছে। তবে একটি কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, সংবিধানে গোপনীয়তা রক্ষার যে বিষয়টি রয়েছে, সেটি অবজ্ঞা করার কোনো সুযোগ নেই। সেটি মেনেই আমাদের তথ্য অধিকারের বিষয়টি দেখতে হবে।

মনে রাখতে হবে যে, রাষ্ট্রীয় অনেক তথ্যই মূল্যবান এবং এগুলোর সাথে রাষ্ট্রের স্বার্থ জড়িত থাকে। অনেক তথ্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সম্পর্কিত, অনেক আর্থিক ও অর্থনৈতিক তথ্য থাকে যেখানে জাতীয় স্বার্থ জড়িত। বাজেটের বিভিন্ন তথ্য, স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য, টেন্ডার সম্পর্কিত, জ্বালানি তেলের মূল্য, অর্থ মন্ত্রণালয়ের নানা তথ্য এবং রাষ্ট্রীয় আরও অনেক তথ্য থাকে যেগুলোর বিষয়ে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ঐ তথ্যগুলো প্রকাশিত হলে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হতে পারে। এই কারণে পৃথিবীর সকল দেশেই রাষ্ট্রীয় নথিগুলোকে ক্লাসিফাইড ডকুমেন্ট হিসেবে দেখা হয়।

আমাদের দেশের সচিবালয়সহ সরকারি দপ্তরগুলোতে সাংবাদিকরা যেভাবে অবাধে তথ্য সংগ্রহ করেন, পৃথিবীর আর কোনো দেশে সাংবাদিকরা এতটা স্বাধীনতা ভোগ করেন না। তথ্য সংগ্রহের জন্য তথ্য চুরি শুধু অপরাধই নয়, এটি সংবিধানেরও লঙ্ঘন। সরকারি দপ্তরের কোনো কর্মকর্তার নথি থেকে গোপনে কাগজপত্র সরিয়ে নেয়া কিংবা গোপনে ছবি তুলে নেয়া তথ্য চুরির মধ্যে পড়ে। এই ধরনের অনৈতিক ও বেআইনি কাজ সাংবাদিকতার নীতিবিরোধী।

সাংবাদিক অবশ্যই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করবেন। তার জন্য তথ্য চুরির প্রয়োজন হয় না। একজন পরিশ্রমী সাংবাদিক চাইলে মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিবসহ বিভিন্ন কর্মকর্তার সাথে কথা বলে এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত বিভিন্ন আইন, পলিসি, রেগুলেটরি আদেশ, মন্ত্রিপরিষদ ও আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ইত্যাদি সম্পর্কে নিয়মিত স্টাডি করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা দপ্তরের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত পর্যবেক্ষণ করলে অনেক তথ্যই সংগ্রহ করতে পারেন।

এ ছাড়া, সাংবাদিকরা মন্ত্রণালয়সমূহের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে অংশ নেন। সেখানে তারা মন্ত্রী, সচিবকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে পারেন। তারপরও কোনো সাংবাদিক সন্তুষ্ট না হলে তিনি মন্ত্রী, সচিবসহ অন্যান্য কর্মকর্তার কক্ষে গিয়ে তার সাথে খোলামেলা আলাপ করে বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করতে পারেন। এই পদ্ধতি অবলম্বন করলে একজন সাংবাদিক ওই মন্ত্রণালয়ে কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে বুঝতে পারবেন এবং তিনি এই অনিয়মের কথা লিখতে পারবেন।

আমাদের দেশের অধিকাংশ সাংবাদিকই এই ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করেন এবং তারা সত্যিকার অর্থে মেধাবী ও পরিশ্রমী সাংবাদিক। কিন্তু সরকারি দপ্তর থেকে তথ্য চুরির বিষয়টি একদিকে যেমন একটি অপরাধ, অন্যদিকে এই প্রবণতার কারণে সরকারি দপ্তরগুলোর কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী তথ্য চুরির বিষয়টির সাথে যুক্ত হয়ে একটা সিন্ডিকেট তৈরি করে দেশের অনেক ক্ষতি করতে পারে। দেশি-বিদেশি কিছু ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটও তথ্য চুরির সাথে সংশ্লিষ্ট এই গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে নানা অবৈধ স্বার্থ হাসিল করতে পারে। তাই তথ্য চুরির বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখা ঠিক হবে না ।

আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নই। কেউ অপরাধ করলে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। অপরাধীকে শাস্তি পেতে হবে। আবার, কেউ যাতে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত না হয় সেটিও সবাইকে দেখতে হবে।

সাংবাদিক রোজিনার বিষয়টি নিয়ে দেশে-বিদেশে যেভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, আমার কাছে মনে হয় এটি একটি নতুন ষড়যন্ত্র। যারা সরকারের এক যুগ ধরে নিরবচ্ছিন্ন সাফল্য আর অগ্রগতিকে মেনে নিতে পারছে না, তারাই মূলত এই ষড়যন্ত্রের কলকাঠি নাড়ছে। এই বিষয়ে আমাদের সবাইকে একটু সতর্ক থাকতে হবে।

লেখক: তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

এ বিভাগের আরো খবর